
মুন্নি আক্তার,নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
টান টান উত্তেজনা। হৃদকম্পন; হৃদয়ে রক্তক্ষরণও। স্নায়ুক্ষয়। পেন্ডুলামের মতো একবার এদিক, আরেকবার ওদিকে দুলছে ম্যাচ। গোল আর পাল্টা গোল। ৪৫ পেরিয়ে ৯০, তারপর ১০৫ থেকে ১২০ মিনিট। প্রতিটা সেকেন্ড, প্রতিটা মিনিট উত্তেজনায় পূর্ণ। এমন নাটকীয়তা দেখল কাতারের লুসাইল স্টেডিয়াম। অবশেষে সব নাটকের অবসান ঘটল। বিশ্বকাপ উঠল একালের ফুটবল জাদুকর মেসির হাতে। মেসির স্বপ্নপূরণ হলো। স্বপ্নকে জয় করলেন। আর আর্জেন্টিনা জয় করল বিশ্বকাপ।
লিওনেল মেসির হাতে বিশ্বকাপ-এ দৃশ্য দেখতে উন্মুখ ছিল পুরো বিশ্ব। এশিয়া থেকে ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে ওশানিয়া, লাতিন থেকে মধ্য আমেরিকা-সর্বত্রই প্রার্থনা ছিল একটি। মেসির হাতেই উঠুক এবারের বিশ্বকাপ। এমন প্রার্থনা যখন বিশ্বজুড়ে তখন ঈশ্বরও যেন অপেক্ষায় ছিলেন, কখন মেসির হাতে বিশ্বকাপটা তুলে দেবেন। তবে তার আগে জাদুকরের কাছে একটু পরীক্ষা নিলেন। আর সেই পরীক্ষায় শতভাগ নম্বর পেয়ে জাদুকর মেসি চুম্বন দিলেন সোনালি ট্রফিতে। বিশ্বকাপের জন্য ৩৬ বছর ধরে অপেক্ষা করছিল আর্জেন্টিনা। ফাইনালে রুদ্ধশ্বাস ১২০ মিনিট পেরিয়ে হৃদকম্পন বাড়ানো টাইব্রেকারে আরো একবার বাজিমাত আর্জেন্টিনার। ফ্রান্স হারল ৪-২ গোলে।
১৯৮৬ সালের মেক্সিকোতে আরেক আর্জেন্টাইন ফুটবল-ঈশ্বর দিয়েগো ম্যারাডোনার হাতে যে বিশ্বকাপ শোভা পেয়েছিল, সেটি আরেকবার হাতে তুলতে আর্জেন্টাইনরা কত বন্দরেই তো নোঙর করেছে। কিন্তু সব বন্দর থেকে রশি ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে স্বপ্নপূরণের জাহাজটি। ১৯৯০ সালের রোম অলিম্পিক স্টেডিয়াম, ২০১৪ সালের ব্রাজিলের ঐতিহাসিক মারকানা স্টেডিয়াম-বারবার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। তীরে এসে তরী ডুবিয়েছে আলভেসেলেস্তারা। স্বপ্ন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছিল।
ম্যারাডোনা যুগের অবসানের পর অতৃপ্তি নিয়ে চলে গেলেন পরপারে। কিন্তু স্বপ্নের বাটনটা দিয়ে গেলেন জাদুকর মেসির হাতে। ২০ বছর ধরে তিনি এই বাটন নিয়ে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বরাবরই ফিনিশিং পয়েন্টে যাওয়ার আগে ছিটকে যাচ্ছিলেন। অবশেষে সেই জাদুকরের হাতেই ঈশ্বর দিলেন বিশ্বকাপ। সব বাধা ডিঙিয়ে মেসি পৌঁছে গেলেন স্বপ্নের শিখরে। আর্জেন্টিনা জিতল তৃতীয় বিশ্বকাপ। অবসান হলো ৩৬ বছরের অপেক্ষার।
আগের প্রজন্মের কাছে ফুটবলের রাজা কালো মনিক পেলে। কিন্তু তার খেলা দেখেনি এই প্রজন্ম। এরপর ফুটবল বিশ্বে বিরল প্রতিভা ফুটবল জাদু নিয়ে হাজির হওয়া ম্যারাডোনাকে এ প্রজন্মের ক’জনইবা দেখেছেন। প্রতিনিয়ত দেখছেন মেসিকে। তিনি ফুটবল বিশ্বের সকল রেকর্ড, ইতিহাস আর পরিসংখ্যান পদদলিত করেছেন। এমন কোনো ট্রফি বা পুরস্কার নেই যা উঠেনি এই জাদুকরের হাতে। সবশেষ কোপা আমরিকা কাপ জিতে আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের শিরোপা খরা মিটিয়েছেন।
বাকি ছিল স্বপ্নের বিশ্বকাপ। আর স্বপ্নপূরণ করে মেসি এখন বিশ্ব ফুটবলের স্বর্ণালী শিখরে।
১৯৮৬ সালের মেঙিকো সিটির ইস্তাদিও অ্যাজতেকার এবং ২০২২ সালের কাতারের রাজধানী দোহার লুসাইল স্টেডিয়ামের দারুণ মিল। সেদিনের নায়ক ম্যারাডোনা আর আজকের নায়ক মেসি। ম্যারাডোনা যাকে বলেছিলেন যোগ্য উত্তরসূরি। কিন্তু গুরুকে কেন যেন স্পর্শ করতে পারছিলেন না। দুজন মিলেও চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু হয়নি। অবশেষে হয়েছে। তাই তো গতকালের ফাইনাল খেলা শেষে গ্যালারিতে ভেসে উঠল দিয়েগো ম্যারাডোনার ছবি। মেসির পাশাপাশি এই মানুষটির আত্মার শান্তি দিতেই যে বিশ্বকাপটা জিততে চেয়েছিল আর্জেন্টাইনরা। অবশেষে সবকিছু একবিন্দুতে মিলে গেল। আর্জেন্টিনা ৩৬ বছর পর জিতল বিশ্বকাপ। মেসির শেষ বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে পেলেন সোনালি ট্রফিটা। এমন মোক্ষম উপলক্ষ কোথায় পাওয়া যাবে?
একটি ট্রফির জন্য কত আরাধনা! কত চোখের জল গড়াল। কত তারকা নিভে গেল। অবশেষে ফুটবল জাদুকরের পায়ে এসে নত হলো। টানা দুইবার বিশ্বকাপের ফাইনালে গিয়ে ব্রাজিলের পাশে গিয়ে বসেছিল ফ্রান্স। আরেকটা রেকর্ডে ব্রাজিলের সাথে ভাগ বসানোর প্রত্যাশা ছিল। আর সেটি হচ্ছে টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ জেতা। কিন্তু ফ্রান্সের সেই স্বপ্নে জল ঢেলে দিল আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনার পর এবার মেসির নামটা লেখা হয়ে গেল সোনার হরফে। কারণ, বিশ্বকাপটা যে এখন তার হাতের মুঠোয়! সোনালি এই ট্রফিতে চুমু খেতে কত সাধনাই না করতে হয়েছে। অবশেষে সফল হলো সব চেষ্টা। বৃথা যায়নি পরিশ্রম। পাওয়া হয়ে গেল সবকিছুু।
আকাশি-নীল জার্সির রঙে আকাশ ছুঁয়ে ফেলল মেসি ও তার দল। লুসাইল স্টেডিয়ামের সব বাতির আলো যেন একযোগে পড়ল মেসির গায়ে। আলোর চেয়ে যেন উজ্জ্বল মেসি-ডি মারিয়ারা।
আর্জেন্টিনার স্বপ্নপূরণের দিনে স্বপ্ন ভেঙে গেল ফ্রান্সের। অথচ বিশ্বকাপ ফাইনালে কিলিয়াম এমবাপের হ্যাটট্রিক। তা-ও ১৯৬৬ সালের পর। ইংলিশ স্ট্রাইকার জিওফ হার্স্টের পর দ্বিতীয় ফুটবলার এমবাপে যিনি ফাইনালে হ্যাটট্রিক করলেন। কিন্তু সবকিছু নিভে গেল টাইব্রেকার নামক ভাগ্য পরীক্ষায় আমিলেয়ানো মার্তিনেস নামক এক বাজপাখির সামনে। ৩৬ বছল পর বিশ্বকাপ জয়ে লিওনেল মেসি যদি হন নায়ক, তাহলে মার্টিনেস মহানায়ক। যদিও মেসির ঝলকানিতে অনেকটাই ম্লান বিশ্বকাপের সেরা এই গোলরক্ষক। কিন্তু আসল নায়ক যে তিনিই।
আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা যতটা না জিততে চেয়েছিল নিজেদের জন্য তার চেয়ে বেশি চেয়েছিল মেসির জন্য। শেষ পর্যন্ত মেসি, আর্জেন্টিনা, লিওনেল স্কালোনি সবার সম্মিলিত ফল আর্জেন্টিনার ঘরে আরেকটি বিশ্বকাপ। ৩৬ বছর ধরে ডাবল স্টারে আটকে থাকা আর্জেন্টিনার জার্সিতে এবার যোগ হবে থ্রি স্টার। জয়তু আর্জেন্টিনা, জয়তু মেসি। বিশ্বকাপে নিজের শেষ ম্যাচটা খেলে ফেলা মেসি যেন জীবনের সব অপূর্ণতা পূরণ করে নিলেন। সাফল্যের হাজারো মুকুটে যোগ হলো সেরা পালকটি, যেটির জন্য আজীবন স্বপ্ন লালন করছিলেন।
ম্যাচের শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক আর্জেন্টিনা। প্রতিপক্ষ ফ্রান্সের পায়ে বল যেতে পারবে না-সে মন্ত্র নিয়েই যেন মাঠে নামেন মেসিরা। যেখানে বল সেখানেই আর্জেন্টিনার ফুটবলার। আর এই কৌশলে সফল আর্জেন্টিনা। শুরুতে মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আক্রমণে যাওয়া শুরু করে। একটি সংঘবদ্ধ আক্রমণ থেকে ৭ মিনিটেই এগিয়ে যেতে পারত আর্জেন্টিনা। ফ্রান্স ডি বঙের ঠিক বাইরে থেকে ডি পল যে শট নিয়েছিলেন তা ভারানের